বাংলাদেশের গ্যাস দিয়ে ভারতে তৈরি হচ্ছে ৭২৬ মেগাওয়াটের বিদ্যুত্ প্লান্ট
বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলায় ৭২৬ মেগাওয়াটের যে বিদ্যুত্ কেন্দ্রটি স্থাপন হচ্ছে, তা বাংলাদেশের গ্যাস ব্যবহার করেই বিদ্যুত্ উত্পাদন করবে বলে ভারতের মিডিয়া দাবি করেছে। দি সাইফাইনিউজ তার ২১ আগস্ট সংস্করণের ‘ওএনজিসি সেটআপ ফার্স্ট পাওয়ার প্রজেক্ট টু রান বাংলাদেশ গ্যাস’ শিরোনামের এক সংবাদে এটা দাবি করা হয়েছে। এদিকে ভারতের ইকোনোমিক টাইমস পত্রিকায় ২১ আগস্ট প্রকাশিত এক রিপোর্টে বলা হয়, বাংলাদেশ চাইলে ওই কেন্দ্র থেকে উত্পাদিত বিদ্যুত্ কিনে নিতে পারবে।
ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলা থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরে পলাতনা নামক জায়গায় এ প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে। এটা হচ্ছে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় এলাকায় সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগের প্রকল্প। এ প্রকল্পে ব্যয় হচ্ছে ৯ হাজার কোটি ভারতীয় রুপি। এ পাহাড়ি এলাকাটিতে ৮ দশমিক ৪ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস মজুত রয়েছে বলে ভারত দাবি করে। তবে বাংলাদেশ থেকে কিভাবে এ বিদ্যুত্ প্রকল্পে গ্যাস সরবরাহ করা হবে সে ব্যাপারে বিস্তারিত কিছু বলেনি ভারতীয় মিডিয়াটি।
মিডিয়াটি তার ২১ আগস্টের অনলাইন সংস্করণে লিখেছে, ভারতের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন দি ওয়েল অ্যান্ড ন্যাচারাল গ্যাস করপোরেশন লিমিটেড (ওএনজিসি) আগরতলায় ৭২৬ মেগাওয়াটের যে বিদ্যুত্ প্রকল্প স্থাপনের কাজ হাতে নিয়েছে, সেই প্রকল্পের প্রথম ইউনিট স্থাপন এরই মধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। এ প্রকল্প বাংলাদেশী গ্যাসের সাহায্যে চলবে।
ওএনজিসি জানিয়েছে, আগামী বছরের শেষ নাগাদ এ বিদ্যুত্ প্রকল্প থেকে উত্পাদন শুরু হবে। সংবাদ মাধ্যমটি ওএনজিসির চেয়ারম্যান আরএস শর্মার উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছে, পলাতনা বিদ্যুত্ প্রকল্পের প্রথম ইউনিট থেকে ভারতবাসী বিদ্যুত্ পাওয়া শুরু করবেন ২০১১ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে। আর পুরো প্রকল্প চালু হবে ২০১২
সালের মার্চ মাসের মধ্যে। ২০০৫ সালের অক্টোবর মাসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং এ প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। এ প্রকল্প সচল করতে এরই মধ্যে প্রকল্প এলাকায় গ্যাস লাইন বসানো হয়েছে।
ওএনজিসি চেয়ারম্যান আরএস শর্মা মিডিয়াকে জানিয়েছেন, এ প্রকল্পের প্রথম ইউনিট থেকে আগামী বছরের ডিসেম্বর নাগাদ বিদ্যুত্ পাওয়া যাচ্ছে—এমন ধরনের নিশ্চয়তা তিনি সরকারের বিভিন্ন উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমি মনে করছি এ প্রকল্পটি শুধু ত্রিপুরা রাজ্যের জন্য আর্থিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ নয়, এটা পুরো উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় ভারতের অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। সবচেয়ে বড় কথা, এ প্রকল্প দুটি দেশের মাঝে সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করে যাবে।’
আরএস শর্মার এ দুটি দেশের মধ্যে একটি হচ্ছে বাংলাদেশ। কারণ, তিনি পরে বেশ খোলামেলাভাবেই বলেছেন, এ প্রকল্পের ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে যে ধরনের সহযোগিতা, পারস্পরিক বোঝাপড়া ও সমর্থন দেখা যাচ্ছে, তাতে আমার মনে হচ্ছে বাংলাদেশ ও ভারত এ প্রকল্পের ব্যাপারে এক হয়ে গেছে। এ ধরনের সম্পর্ক দেখতে পেয়ে আমাদের ভালো লাগছে।
উল্লেখ্য, এ প্রকল্পের কাজে ব্যবহৃত ভারি মেশিনপত্র বাংলাদেশের ভূখণ্ড দিয়ে আগরতলায় নেয়া হবে। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে খোলামেলা কিছু বলা না হলেও মিডিয়া মতে, মেঘনা নদীর তীরে অবস্থিত আশুগঞ্জ নদীবন্দর দিয়ে নৌপথে এসব ভারতীয় সরঞ্জাম ভারত থেকে বাংলাদেশে ঢুকবে এবং বাংলাদেশের সড়কপথ ব্যবহার করে ভারতীয় ভারি যানযোগে তা আখাউড়া হয়ে আগরতলায় যাবে। এ সময় বাংলাদেশী কোনো যানবাহন চলাচল করতে পারবে না। শুধু তাই নয়, বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশীদের পক্ষ থেকে কোনো আপত্তি বা প্রতিরোধ যাতে গড়ে উঠতে না পারে সে ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকার এরই মধ্যে প্রশাসনকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়ে রেখেছে।
ভারতীয় মিডিয়া মতে, পলাতনা প্রকল্প যখন সম্পন্ন হবে তখন বাংলাদেশও চাইলে এ প্রকল্প থেকে বিদ্যুত্ কিনতে পারবে। আর বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান বিদ্যুত্ চাহিদা মেটাতে ভারতও বাংলাদেশের কাছে বিদ্যুত্ বিক্রি করতে আগ্রহী।
ভারতের ইকোনোমিক টাইমস পত্রিকার ২১ আগস্ট সংস্করণেও বলা হয়েছে, বাংলাদেশ চাইলেই এ প্রকল্প থেকে বিদ্যুত্ কিনে তার চাহিদা মেটাতে পারবে।
সূত্রঃ http://mynewspapercut.blogspot.com/2010/08/blog-post_2878.html
আওয়ামী লীগের বড় দুর্বলতা তার প্রচার ব্যর্থতা
আওয়ামী লীগের বড় দুর্বলতা তার প্রচার ব্যর্থতা। সেটা স্বাধীনতার আগে থেকে এবং সে ধারাবাহিকতা এখনো অব্যাহত। স্বাধীনতা সংগ্রামের ধাপে ধাপে তদানীন্তন পূর্ব বাংলার প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানি নেতাদের তরফ থেকে সর্বক্ষেত্রে অবহেলা ও বঞ্চনার প্রতিবাদ করেছেন শাসক দল মুসলিম লীগের এ দেশীয় সমর্থকরা বাদে প্রদেশের বিরোধীদলীয় নেতাদের অধিকাংশই বর্ষীয়ান নেতাÑ হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে। তাদের বক্তব্য প্রতিদিন জনতার কাছে পৌঁছে দিতে অবশ্যই অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে মানিক মিয়া সম্পাদিত দৈনিক ইত্তেফাকÑ সাপ্তাহিক হিসেবে যার শুরু একই ভূমিকায়।
দৈনিক আজাদ, সংবাদ, পাকিস্তান অবজাভার ইত্তেফাকের মতো ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে পারেনি তাদের সংশ্লিষ্ট ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের মতো পথ ও নীতির ঘন ঘন পরিবর্তনের কারণে। সেক্ষেত্রে ইত্তেফাকই আওয়ামী লীগের প্রচারপত্রের ভূমিকা পালন করেছে। যদিও মানিক মিয়ার তিরোধানের পর পূর্ব বাংলার সবচেয়ে প্রয়োজনীয় মুহূর্ত ’৭০-এর নির্বাচনের আগে তার জ্যেষ্ঠ ছেলের ইচ্ছায় তৎকালীন ইত্তেফাকের বার্তা বিভাগ দুই কূল রক্ষার নীতি গ্রহণের পথ অনুসরণ চেষ্টার সঙ্গে সঙ্গেই একদিন গভীর রাতে সপারিষদ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ইত্তেফাক ভবনে আসতে হয়েছিল। পরেরদিন থেকে ইত্তেফাক আগের নীতিতে ফিরে যায়। আমি তখন ইত্তেফাকে কর্মরত। ঘটনার রাতের আমি নীরব সাক্ষী। স্বাধীনতার পর দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে অনাকাক্সিক্ষত উত্তপ্ত পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে শুরু করে। জাসদের নেতৃত্বে অস্থিরতার সঙ্গে যোগ হয় সে দলের মুখপত্র গণকণ্ঠ আল মাহমুদের সম্পাদনায়। টাঙ্গাইল থেকে মওলানা ভাসানীর নৈতিক ও আর্থিক সহযোগিতায় এরফানুল কবীরের সম্পাদনায় নিয়মিতভাবে প্রকাশিত হতে থাকে সাপ্তাহিক ‘হক কথা’। সরকারবিরোধী রাজনীতিকে গতিময় করতে ওই দুটি পত্রিকা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিল।
স্বাধীনতার পর ইত্তেফাক কর্তৃপক্ষের ইচ্ছায় পত্রিকাটি মধ্যপন্থা অবলম্বন করে। সরকার সমর্থক পত্রিকা বলতে ট্রাস্ট মালিকানাধীন দৈনিক বাংলা (আগে ছিল দৈনিক পাকিস্তান) এবং মর্নিং নিউজ। দৈনিক বাংলা সর্বক্ষেত্রে মানসম্মত হলেও সরকার সমর্থক বলে পাঠকপ্রিয়তা আশানুরূপ ছিল না কিছুকাল। মর্নিং নিউজের পাঠক সংখ্যা ছিল খুবই কম। সে তুলনায় বাংলাদেশ অবজারভারের চাহিদা ছিল। সরকারের একনিষ্ঠ সমর্থক ছিল শেখ ফজলুল হক মনি সম্পাদিত ‘বাংলার বাণী’। পত্রিকার প্রচার সংখ্যা আশানুরূপ ছিল না। আমি তখন সে পত্রিকায়। পরে বাংলাদেশ টাইমস একই আদর্শ নিয়ে বের হলেও সে পত্রিকার প্রচার বাংলার বাণীর মতোই ছিল।
এত কথার উদ্দেশ্য হলোÑ দল হিসেবে আওয়ামী লীগ স্বাধীনতা পূর্বকালের ইত্তেফাকের মতো অন্য কোনো পত্রিকার একনিষ্ঠ সমর্থন লাভ করেনি, যার প্রচার সংখ্যা ছিল ওই সময়ের প্রেক্ষাপটে ঈর্ষণীয়। এখন যদি দল হিসেবে আওয়ামী লীগ এবং সে দলের সরকার মনে করে যে, তাদের প্রতি সংবাদপত্রগুলোর আন্তরিক সমর্থন সবার তরফ থেকে না হলেও সিংহভাগের থাকবে তাহলে ধারণাটা হবে ভুল এবং সে ভুলটাই করে এসেছেন দলীয় এবং সরকার প্রধান। নাম উল্লেখ করা উচিত হবে না বলেই উল্লেখ করলাম নাÑ তবুও হাতেগোনা কয়েকটি সংবাদপত্র মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের সরকার হিসেবে দল এবং সরকার হিসেবে আওয়ামী লীগকে সমর্থন দিচ্ছে।
দুঃখজনক যে, সরকারের কোনো কোনো কাজের গঠনমূলক সমালোচনার গুরুত্ব সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের অনেকে বাঁকা চোখে দেখেন। মধ্যম ও তৃণমূল নেতাকর্মীদের কথা বাদই দিলাম। কারণ কে কোন গঠনমূলক লেখাপড়ার আগ্রহ এবং তা অনুধাবন করার মতো শিক্ষা-দীক্ষা, মনন ও প্রজ্ঞা শুধু আওয়ামী লীগ নয়, দেশের অধিকাংশ দলীয় নেতাকর্মীর মধ্যে অনুপস্থিত। কারণ যে কোনো বিষয় সম্পর্কে লেখাপড়ার পর তা ধারণ ও বিবেচনায় আনার জন্য যে সময়ের প্রয়োজন, সে সময়টুকু হাতে রাখেন না তারা রাজনীতিতে হাতেখড়ির আগে থেকেই। কথাটা অপ্রিয়; কিন্তু সত্যি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় লালিত সরকারের ভালো কাজের বিষয় গুটিকয়েক সংবাদপত্রের মাধ্যমে যতটুকু প্রচারিত হচ্ছে এবং সরকারের গঠনমূলক কাজের গতিকে ত্বরান্বিত করার কাজে সংবাদপত্রের প্রতিবেদক ও কলাম লেখকরা নিজ প্রেরণায় তা করলেও সংশ্লিষ্ট সংবাদপত্রগুলোর মালিক এবং ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের সত্যিকার আন্তরিকতা না থাকলে ওই প্রতিবেদন এবং কলামগুলো প্রকাশের ক্ষেত্রে বিস্তর প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হতো। সরকারের উচিত পত্রিকাগুলোকে বর্তমান সংবাদপত্র বাণিজ্যের যুগে এক ধরনের ঝুঁকি নিয়েও যে তারা জাতীয় দায়িত্ব পালন করছেন সে জন্য তাদের সাধুবাদ জানানো।
জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজের অনেক তালিকা রয়েছে; কিন্তু সে অনুযায়ী সরকারের কাজের তৎপরতা নেই। ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে ক্ষমতা অথবা দায়িত্ব গ্রহণের পর সরকারের তরফ থেকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের অগ্রাধিকারভিত্তিক তালিকা তৈরি করে তা মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, সচিব এবং প্রধানমন্ত্রীর দফতরে রাখার প্রয়োজন ছিল। এই সেদিন প্রধানমন্ত্রীর মুখে কথাটা সর্বপ্রথম উচ্চারিত হতে দেখলাম। অন্যের কথা বাদই দিলাম।
এইচ টি ইমাম, ডা. মসিউর রহমান এবং ড. তৌফিক-ই এলাহী চৌধুরীরা তো মন্ত্রণালয় চালিয়ে এসেছেন সচিব হিসেবে। একজন তো কেবিনেট সেক্রেটারিও ছিলেন। চেকলিস্ট একদিন অগ্রাধিকারভিত্তিতে প্রধানমন্ত্রীর রক্ষার আগে ছিল কি না জানতে ইচ্ছা হয়। না, তাও করা হয়নি। লিস্ট করলে তো হবে না। প্রাত্যহিক কাজের অগ্রগতি মনিটর করাই অপরিহার্য। বিদ্যুৎ নিয়ে আর কথা বলতে ইচ্ছা হয় না। তবুও বিদ্যুৎক্ষেত্রে এর আগে যারা কর্মের দ্বারা অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন তাদের সঙ্গে কথা বলে ধারণা জন্মেছে দেশের বিদ্যুৎ চাহিদার সিংহভাগ পূরণ হবে ২০১৩ সাল নাগাদ, যদি সরকারের গৃহীত বর্তমানের উদ্যোগগুলোকে অব্যাহত রাখা যায়। যদি তাই হয়, তাহলে সরকারের কর্মকৌশল জনগণকে জানানো হচ্ছে না কেন? তৌফিক-ই এলাহী চৌধুরীর ওপর ভরসার কথা কেউ বলেন না। বলেন না প্রতিমন্ত্রী অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেলের কথা। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা স্বয়ং এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত। কবে নাগাদ কী পরিমাণ বিদ্যুৎ জাতীয় সঞ্চালন গ্রিডে যুক্ত হবে নিয়মিতভাবে প্রচারমাধ্যমে জনগণকে তা জানিয়ে দিতে হবে। যে দুজনের ওপর তিনি নির্ভর করছেন তারা দুজনেই সাবেক চাকরিজীবীÑ যাদের প্রধান কাজই ছিল তথ্য গোপন করা।
বিগত সরকার কিছু করেনি, কথাটা সত্য। কিন্তু আপনি পরিস্থিতি উন্নয়নে কী করতে চান জাতিকে জানিয়ে দিন। বড়পুকুরিয়াতে কয়লা উত্তোলন শুরু হয়েছে সে কথা একটা-দুটো কাগজে প্রচারিত হবে কেন? ওই কয়লা উত্তোলনের পর সে কয়লা দিয়ে কীভাবে দেশ উপকৃত হবে তা প্রচারমাধ্যমে ব্যাপকভাবে জানিয়ে দেয়া হচ্ছে না কেন? গ্যাস সংকট মোকাবিলায় দ্রুত পাঁচটি কূপ খনন ও পুরনো একটি কূপ মেরামতের খবর একটি কাগজে কেন দেখবো? এই ছয়টি কূপ খনন ও মেরামতের খবর তাতে কতদিনে এবং কত ঘনফুট গ্যাস উত্তোলিত হলে লাভ কী পরিমাণ হবে তা বিস্তারিতভাবে জানিয়ে দেয়া হচ্ছে না কেন?
হারুন-উর রশীদকে আনা হয়েছে অবসর থেকে আবার বিআইও পদে। ভালো অফিসার। ডেডিকেটেড। তার ওপর পুরো সরকারের গৃহীত কর্মসূচি প্রচারের দায়িত্ব দেয়া হচ্ছে না কেন? তাহলে প্রতিবেদকদের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় বা বিভাগের জুনিয়র-সিনিয়র কর্মকর্তাদের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হয় না। এরা তো মুখে কুলুপ এঁটে থাকতে অভ্যস্ত। সবাই যদি সময় হাতে নিয়ে পিআইও-এর দফতরে তথ্য পাঠিয়ে দেন, প্রতিবেদকদের এক্সক্লুসিভ খবর ছাড়া সরকারের প্রাত্যহিক গুরুত্বপূর্ণ খবরের জন্য মন্ত্রণালয়গুলোকে অযথা দৌড়াদৌড়ি করে হয়রানি হতে হয় না। ২০০১ সালের নির্বাচনের পর দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এবং আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ওপর নির্যাতনের তদন্ত কাজ গুরুর জন্য একটি মানবাধিকার সংগঠনের আবেদনক্রমে হাইকোর্ট সরকারকে একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠনের নির্দেশ দেন। পাঠক লক্ষ্য করুন, নির্যাতিত হয়েছিল আওয়ামী লীগ এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। অথচ তদন্ত করার উদ্যোগ নিতে হলো অন্যকে হাইকোর্টের কাছে। কমিশন প্রধান অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ সাহাবুদ্দিন দুঃখ করেছেন এই বলে যে, সরকারদলীয় এমপি এবং অন্যদের কাছ থেকে তিনি সহযোগিতা পাচ্ছেন না। ২০০১ সালের নির্বাচনের পর যে পরিমাণ নির্যাতন হয়েছে তার এক-চতুর্থাংশও সঠিকভাবে অভিযোগ দাখিল করার কাজে এগিয়ে আসতে পারছেন না এ জন্য যে, দলীয় লোকেরা যারা প্রকৃত ঘটনাবলি যথাযথভাবে উপস্থাপনের যোগ্যতা রাখেন কমিশনের কাছে, তাদের সম্ভবত ব্যস্ততা অন্য কাজে। কমিশন চেয়ারম্যান বলেছেন, সাধারণত একটা ঘটনার জন্য একটা কমিশন গঠিত হয়। অথচ প্রকৃত নির্যাতনের ঘটনা তো অনেক-অনেক। কমিশনের সংখ্যা বৃদ্ধি অপরিহার্য। নেতাকর্মীদের সহায়তা দরকার। তিনি আক্ষেপ করেছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উদাসীনতা বিষয়ে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্লিপ্ততা হতাশাব্যঞ্জক। আমরা আশা করবো, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী বিষয়টা গুরুত্বের সঙ্গে আমলে নিয়ে প্রত্যেক এমপি, দলীয় জেলা সভাপতিকে পত্র দেয়ার ব্যবস্থার সঙ্গে কমিশনকে সর্বাত্মক সহায়তা দেয়ার জন্য অবিরাম প্রচারমাধ্যমের সাহায্য নেয়া হবে।
শেখ গোলাম মোস্তফা
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
দৈনিক আজাদ, সংবাদ, পাকিস্তান অবজাভার ইত্তেফাকের মতো ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে পারেনি তাদের সংশ্লিষ্ট ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের মতো পথ ও নীতির ঘন ঘন পরিবর্তনের কারণে। সেক্ষেত্রে ইত্তেফাকই আওয়ামী লীগের প্রচারপত্রের ভূমিকা পালন করেছে। যদিও মানিক মিয়ার তিরোধানের পর পূর্ব বাংলার সবচেয়ে প্রয়োজনীয় মুহূর্ত ’৭০-এর নির্বাচনের আগে তার জ্যেষ্ঠ ছেলের ইচ্ছায় তৎকালীন ইত্তেফাকের বার্তা বিভাগ দুই কূল রক্ষার নীতি গ্রহণের পথ অনুসরণ চেষ্টার সঙ্গে সঙ্গেই একদিন গভীর রাতে সপারিষদ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ইত্তেফাক ভবনে আসতে হয়েছিল। পরেরদিন থেকে ইত্তেফাক আগের নীতিতে ফিরে যায়। আমি তখন ইত্তেফাকে কর্মরত। ঘটনার রাতের আমি নীরব সাক্ষী। স্বাধীনতার পর দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে অনাকাক্সিক্ষত উত্তপ্ত পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে শুরু করে। জাসদের নেতৃত্বে অস্থিরতার সঙ্গে যোগ হয় সে দলের মুখপত্র গণকণ্ঠ আল মাহমুদের সম্পাদনায়। টাঙ্গাইল থেকে মওলানা ভাসানীর নৈতিক ও আর্থিক সহযোগিতায় এরফানুল কবীরের সম্পাদনায় নিয়মিতভাবে প্রকাশিত হতে থাকে সাপ্তাহিক ‘হক কথা’। সরকারবিরোধী রাজনীতিকে গতিময় করতে ওই দুটি পত্রিকা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিল।
স্বাধীনতার পর ইত্তেফাক কর্তৃপক্ষের ইচ্ছায় পত্রিকাটি মধ্যপন্থা অবলম্বন করে। সরকার সমর্থক পত্রিকা বলতে ট্রাস্ট মালিকানাধীন দৈনিক বাংলা (আগে ছিল দৈনিক পাকিস্তান) এবং মর্নিং নিউজ। দৈনিক বাংলা সর্বক্ষেত্রে মানসম্মত হলেও সরকার সমর্থক বলে পাঠকপ্রিয়তা আশানুরূপ ছিল না কিছুকাল। মর্নিং নিউজের পাঠক সংখ্যা ছিল খুবই কম। সে তুলনায় বাংলাদেশ অবজারভারের চাহিদা ছিল। সরকারের একনিষ্ঠ সমর্থক ছিল শেখ ফজলুল হক মনি সম্পাদিত ‘বাংলার বাণী’। পত্রিকার প্রচার সংখ্যা আশানুরূপ ছিল না। আমি তখন সে পত্রিকায়। পরে বাংলাদেশ টাইমস একই আদর্শ নিয়ে বের হলেও সে পত্রিকার প্রচার বাংলার বাণীর মতোই ছিল।
এত কথার উদ্দেশ্য হলোÑ দল হিসেবে আওয়ামী লীগ স্বাধীনতা পূর্বকালের ইত্তেফাকের মতো অন্য কোনো পত্রিকার একনিষ্ঠ সমর্থন লাভ করেনি, যার প্রচার সংখ্যা ছিল ওই সময়ের প্রেক্ষাপটে ঈর্ষণীয়। এখন যদি দল হিসেবে আওয়ামী লীগ এবং সে দলের সরকার মনে করে যে, তাদের প্রতি সংবাদপত্রগুলোর আন্তরিক সমর্থন সবার তরফ থেকে না হলেও সিংহভাগের থাকবে তাহলে ধারণাটা হবে ভুল এবং সে ভুলটাই করে এসেছেন দলীয় এবং সরকার প্রধান। নাম উল্লেখ করা উচিত হবে না বলেই উল্লেখ করলাম নাÑ তবুও হাতেগোনা কয়েকটি সংবাদপত্র মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের সরকার হিসেবে দল এবং সরকার হিসেবে আওয়ামী লীগকে সমর্থন দিচ্ছে।
দুঃখজনক যে, সরকারের কোনো কোনো কাজের গঠনমূলক সমালোচনার গুরুত্ব সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের অনেকে বাঁকা চোখে দেখেন। মধ্যম ও তৃণমূল নেতাকর্মীদের কথা বাদই দিলাম। কারণ কে কোন গঠনমূলক লেখাপড়ার আগ্রহ এবং তা অনুধাবন করার মতো শিক্ষা-দীক্ষা, মনন ও প্রজ্ঞা শুধু আওয়ামী লীগ নয়, দেশের অধিকাংশ দলীয় নেতাকর্মীর মধ্যে অনুপস্থিত। কারণ যে কোনো বিষয় সম্পর্কে লেখাপড়ার পর তা ধারণ ও বিবেচনায় আনার জন্য যে সময়ের প্রয়োজন, সে সময়টুকু হাতে রাখেন না তারা রাজনীতিতে হাতেখড়ির আগে থেকেই। কথাটা অপ্রিয়; কিন্তু সত্যি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় লালিত সরকারের ভালো কাজের বিষয় গুটিকয়েক সংবাদপত্রের মাধ্যমে যতটুকু প্রচারিত হচ্ছে এবং সরকারের গঠনমূলক কাজের গতিকে ত্বরান্বিত করার কাজে সংবাদপত্রের প্রতিবেদক ও কলাম লেখকরা নিজ প্রেরণায় তা করলেও সংশ্লিষ্ট সংবাদপত্রগুলোর মালিক এবং ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের সত্যিকার আন্তরিকতা না থাকলে ওই প্রতিবেদন এবং কলামগুলো প্রকাশের ক্ষেত্রে বিস্তর প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হতো। সরকারের উচিত পত্রিকাগুলোকে বর্তমান সংবাদপত্র বাণিজ্যের যুগে এক ধরনের ঝুঁকি নিয়েও যে তারা জাতীয় দায়িত্ব পালন করছেন সে জন্য তাদের সাধুবাদ জানানো।
জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজের অনেক তালিকা রয়েছে; কিন্তু সে অনুযায়ী সরকারের কাজের তৎপরতা নেই। ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে ক্ষমতা অথবা দায়িত্ব গ্রহণের পর সরকারের তরফ থেকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের অগ্রাধিকারভিত্তিক তালিকা তৈরি করে তা মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, সচিব এবং প্রধানমন্ত্রীর দফতরে রাখার প্রয়োজন ছিল। এই সেদিন প্রধানমন্ত্রীর মুখে কথাটা সর্বপ্রথম উচ্চারিত হতে দেখলাম। অন্যের কথা বাদই দিলাম।
এইচ টি ইমাম, ডা. মসিউর রহমান এবং ড. তৌফিক-ই এলাহী চৌধুরীরা তো মন্ত্রণালয় চালিয়ে এসেছেন সচিব হিসেবে। একজন তো কেবিনেট সেক্রেটারিও ছিলেন। চেকলিস্ট একদিন অগ্রাধিকারভিত্তিতে প্রধানমন্ত্রীর রক্ষার আগে ছিল কি না জানতে ইচ্ছা হয়। না, তাও করা হয়নি। লিস্ট করলে তো হবে না। প্রাত্যহিক কাজের অগ্রগতি মনিটর করাই অপরিহার্য। বিদ্যুৎ নিয়ে আর কথা বলতে ইচ্ছা হয় না। তবুও বিদ্যুৎক্ষেত্রে এর আগে যারা কর্মের দ্বারা অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন তাদের সঙ্গে কথা বলে ধারণা জন্মেছে দেশের বিদ্যুৎ চাহিদার সিংহভাগ পূরণ হবে ২০১৩ সাল নাগাদ, যদি সরকারের গৃহীত বর্তমানের উদ্যোগগুলোকে অব্যাহত রাখা যায়। যদি তাই হয়, তাহলে সরকারের কর্মকৌশল জনগণকে জানানো হচ্ছে না কেন? তৌফিক-ই এলাহী চৌধুরীর ওপর ভরসার কথা কেউ বলেন না। বলেন না প্রতিমন্ত্রী অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেলের কথা। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা স্বয়ং এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত। কবে নাগাদ কী পরিমাণ বিদ্যুৎ জাতীয় সঞ্চালন গ্রিডে যুক্ত হবে নিয়মিতভাবে প্রচারমাধ্যমে জনগণকে তা জানিয়ে দিতে হবে। যে দুজনের ওপর তিনি নির্ভর করছেন তারা দুজনেই সাবেক চাকরিজীবীÑ যাদের প্রধান কাজই ছিল তথ্য গোপন করা।
বিগত সরকার কিছু করেনি, কথাটা সত্য। কিন্তু আপনি পরিস্থিতি উন্নয়নে কী করতে চান জাতিকে জানিয়ে দিন। বড়পুকুরিয়াতে কয়লা উত্তোলন শুরু হয়েছে সে কথা একটা-দুটো কাগজে প্রচারিত হবে কেন? ওই কয়লা উত্তোলনের পর সে কয়লা দিয়ে কীভাবে দেশ উপকৃত হবে তা প্রচারমাধ্যমে ব্যাপকভাবে জানিয়ে দেয়া হচ্ছে না কেন? গ্যাস সংকট মোকাবিলায় দ্রুত পাঁচটি কূপ খনন ও পুরনো একটি কূপ মেরামতের খবর একটি কাগজে কেন দেখবো? এই ছয়টি কূপ খনন ও মেরামতের খবর তাতে কতদিনে এবং কত ঘনফুট গ্যাস উত্তোলিত হলে লাভ কী পরিমাণ হবে তা বিস্তারিতভাবে জানিয়ে দেয়া হচ্ছে না কেন?
হারুন-উর রশীদকে আনা হয়েছে অবসর থেকে আবার বিআইও পদে। ভালো অফিসার। ডেডিকেটেড। তার ওপর পুরো সরকারের গৃহীত কর্মসূচি প্রচারের দায়িত্ব দেয়া হচ্ছে না কেন? তাহলে প্রতিবেদকদের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় বা বিভাগের জুনিয়র-সিনিয়র কর্মকর্তাদের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হয় না। এরা তো মুখে কুলুপ এঁটে থাকতে অভ্যস্ত। সবাই যদি সময় হাতে নিয়ে পিআইও-এর দফতরে তথ্য পাঠিয়ে দেন, প্রতিবেদকদের এক্সক্লুসিভ খবর ছাড়া সরকারের প্রাত্যহিক গুরুত্বপূর্ণ খবরের জন্য মন্ত্রণালয়গুলোকে অযথা দৌড়াদৌড়ি করে হয়রানি হতে হয় না। ২০০১ সালের নির্বাচনের পর দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এবং আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ওপর নির্যাতনের তদন্ত কাজ গুরুর জন্য একটি মানবাধিকার সংগঠনের আবেদনক্রমে হাইকোর্ট সরকারকে একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠনের নির্দেশ দেন। পাঠক লক্ষ্য করুন, নির্যাতিত হয়েছিল আওয়ামী লীগ এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। অথচ তদন্ত করার উদ্যোগ নিতে হলো অন্যকে হাইকোর্টের কাছে। কমিশন প্রধান অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ সাহাবুদ্দিন দুঃখ করেছেন এই বলে যে, সরকারদলীয় এমপি এবং অন্যদের কাছ থেকে তিনি সহযোগিতা পাচ্ছেন না। ২০০১ সালের নির্বাচনের পর যে পরিমাণ নির্যাতন হয়েছে তার এক-চতুর্থাংশও সঠিকভাবে অভিযোগ দাখিল করার কাজে এগিয়ে আসতে পারছেন না এ জন্য যে, দলীয় লোকেরা যারা প্রকৃত ঘটনাবলি যথাযথভাবে উপস্থাপনের যোগ্যতা রাখেন কমিশনের কাছে, তাদের সম্ভবত ব্যস্ততা অন্য কাজে। কমিশন চেয়ারম্যান বলেছেন, সাধারণত একটা ঘটনার জন্য একটা কমিশন গঠিত হয়। অথচ প্রকৃত নির্যাতনের ঘটনা তো অনেক-অনেক। কমিশনের সংখ্যা বৃদ্ধি অপরিহার্য। নেতাকর্মীদের সহায়তা দরকার। তিনি আক্ষেপ করেছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উদাসীনতা বিষয়ে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্লিপ্ততা হতাশাব্যঞ্জক। আমরা আশা করবো, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী বিষয়টা গুরুত্বের সঙ্গে আমলে নিয়ে প্রত্যেক এমপি, দলীয় জেলা সভাপতিকে পত্র দেয়ার ব্যবস্থার সঙ্গে কমিশনকে সর্বাত্মক সহায়তা দেয়ার জন্য অবিরাম প্রচারমাধ্যমের সাহায্য নেয়া হবে।
শেখ গোলাম মোস্তফা
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
মাহমুদুর রহমানের গুরুদণ্ড
অনেক প্রশ্ন ভিড় করল। ‘চেম্বার মানেই সরকার পক্ষে স্টে’। আপিল বিভাগের অবমাননার জন্য অভিযুক্ত আমার দেশ প্রতিবেদনের এটুকুই শিরোনাম ছিল না। এর সঙ্গে আছে, ‘মিথ্যা তথ্যের ভিত্তিতে স্থগিত করা হলো হাইকোর্টের রায়’। খুব আশা করেছিলাম আপিল বিভাগের শুনানিতে সত্য-মিথ্যা যাচাই হবে। এমনকি বাকস্বাধীনতার সীমারেখা হতে পারত এই শুনানির সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক। সেটাও হলো না। তবে এটা অনস্বীকার্য যে, শিরোনাম দারুণভাবে অবমাননাকর। ‘অ্যাটর্নি জেনারেলের দপ্তরের চাহিদা অনুযায়ী বিচার’ নিশ্চয়ই দায়িত্বশীল কথা নয়।
তবে আমাদের অস্বস্তি আমার দেশ-এর তর্কিত প্রতিবেদনের সত্য-মিথ্যা যাচাই হওয়ার বিষয়টি। লেখক হিসেবে সেই আশায় ছিলাম। আদালত অবমাননা নানাভাবে ঘটতে পারে। শুধু যে বিচারক বা আইনজীবীরাই আদালতের ভাবমূর্তি রক্ষার অতন্দ্রপ্রহরী, তা তো নয়। কারণ কোনো বিচারকের ব্যক্তিগত সুনামহানি থেকে রক্ষা করার জন্য আদালতকে এই ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। আদালত অবমাননার সঙ্গে বাকস্বাধীনতা ও মৌলিক মানবাধিকারের একটা চিরকালীন দ্বন্দ্ব আছে। আমরা দুর্ভাগা। আমরা কতটা কী লিখতে পারি বা পারি না, তা সংসদ বা আদালত কেউ আমাদের ঠিক করে দিলেন না।
আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় এলে এ বিষয়ে একটি পরিষ্কার চিত্র পাওয়া যাবে, এমন আশা আমরা করি। এবং তখন এ বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ মতামত দেওয়া যাবে। আদালত যখন বলেন যে তাঁর রায়ের সমালোচনা চলবে, তখন আমরা ভাবি, কত তাড়াতাড়ি আমরা পূর্ণাঙ্গ রায় পাব। আদালত বা সংসদ কেউ তো আমাদের বলে দেন না যে, যুক্তিসংগত বাধা-নিষেধটা কী। এ বিষয়ে ভারতের বিস্তারিত আইন আছে। তদুপরি কিসে আদালত অবমাননা হয় না, তার একটি নীতিমালাও ভারতের সুপ্রিম কোর্ট করে দিয়েছেন। পাকিস্তানের আইন দেখেও ঈর্ষা হয়। সেটাও যথেষ্ট বিস্তারিত। মিথ্যা ও বিকৃত তথ্য ছাপলেই আদালত অবমাননা হবে না, প্রমাণিত হতে হবে যে উদ্দেশ্যটা বিদ্বেষপ্রসূত ছিল কি না। পাকিস্তান এত দূর গেলে আমরা পারি না কেন? আমরা অন্ধকারে হাতড়ে বেড়াই। ২০০৮ সালের আদালত অবমাননা আইন বাতিল হয় হাইকোর্টে। বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক রায় দেন, ‘কোন কোন ক্ষেত্রে বা কী পরিস্থিতিতে আদালত অবমাননা হইবে না বা হইবে, তাহা নির্ধারণ করিবার দায়িত্ব আদালতের। ইহা কোন অধ্যাদেশ দ্বারা সম্পূর্ণভাবে (exhaustively) নির্ধারণ করা যায় না।’
আজকের লেখায় আমি অবশ্য এ-সংক্রান্ত আইনগত ফাঁকফোকর ও দণ্ড প্রদানের দিকটি পর্যালোচনা করতে চাইব। আমরা এত দিন জেনে এসেছি যে আদালত অবমাননার জন্য ছয় মাসের জেল আর দুই হাজার টাকা জরিমানার বিধান আছে। এবার আমরা সম্পূর্ণ নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হলাম। সে কারণেই এই আলোচনা।
বর্তমানে রাজরোষে থাকা ‘বাই চান্স’ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানেরা এ সমাজের চেনা উত্পাত। তাঁর বহু কাণ্ডকীর্তি বিতর্কিত, যা আমাদের কাছে অগ্রহণযোগ্য। সংবাদপত্র আর প্রচারপত্রের সীমারেখা মানতে তিনি উদগ্রীব, তার প্রমাণ পাই না। তবে সে ভিন্ন প্রসঙ্গ।
আমরা জানতাম, ১৯২৬ সালের একটা আদালত অবমাননা আইন আছে। এতে সর্বোচ্চ ছয় মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড কিংবা দুই হাজার টাকা জরিমানা কিংবা উভয়বিধ সাজা দেওয়া যাবে। তাহলে প্রথম খটকা হলো, তাঁর ছয় মাস জেল হলো। এক লাখ টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও এক মাসের জেল হলো। অন্য আরও দুজনের ১০ হাজার টাকা করে জরিমানা হলো। কিন্তু কী করে?
সাবেক প্রধান বিচারপতি মোস্তাফা কামাল আইন কমিশনের চেয়ারম্যান ছিলেন। আদালত অবমাননা বিষয়ে তাঁর তৈরি করা ১৩ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন আছে। সেটা পড়ে আমরা নিশ্চিত জানলাম, ১৯২৬ সালের আইনটি শুধু হাইকোর্ট বিভাগের জন্য প্রযোজ্য, আপিল বিভাগের জন্য নয়। আপিল বিভাগ তাহলে কোন আইনের কোন ধারার আওতায় সাজা দিলেন? এর ভিত্তি কী? অ্যাটর্নি জেনারেল মাহ্বুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন, ‘আপিল বিভাগের বিধিমালা ও সংবিধানের ১০৮ অনুচ্ছেদ অনুসারে আদালত দোষী সাব্যস্ত করে সাজার রায় দিয়েছেন।’ ১৯ আগস্ট আপিল বিভাগের সংক্ষিপ্ত আদেশে দেখলাম, ১০৮ অনুচ্ছেদের কথা আছে। সেখানে ১৯২৬ সালের আইনের উল্লেখ নেই। তবে আপিল বিভাগের সংক্ষিপ্ত আদেশেই তথ্য পেলাম, সাজার ব্যাপারে প্রধান বিচারপতিসহ ছয় বিচারপতি একমত হয়েছেন। কিন্তু সাজার মেয়াদ প্রশ্নে রায় বিভক্ত হয়েছে। ৫: ১ ভোটে সাজার মেয়াদ বহাল হয়।
বাংলাদেশ সংবিধানের ১০৮ অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘সুপ্রিম কোর্ট একটি কোর্ট অব রেকর্ড হইবেন এবং ইহার অবমাননার জন্য তদন্তের আদেশদান বা দণ্ডাদেশদানের ক্ষমতাসহ আইন-সাপেক্ষে অনুরূপ আদালতের সকল ক্ষমতার অধিকারী থাকিবেন।’ এর সরল অর্থ দাঁড়াচ্ছে, আদালত অবমাননার অপরাধের বিচারের এখতিয়ার সুপ্রিম কোর্টকে দেওয়া আছে। সুপ্রিম কোর্ট উভয় বিভাগ নিয়ে গঠিত। এখানে ‘আইন-সাপেক্ষ’ কথাটি গুরুত্বপূর্ণ। সংবিধান সুপ্রিম কোর্টকে বলছে, আপনাকে এই অভিযোগ বিচারের ক্ষমতাটা দিলাম। কিন্তু এর প্রয়োগ করবেন ‘আইনের’ আওতায়। কিন্তু সেই আইন নেই। ১৯২৬ সালের আইনটি সেই আইন নয়। তবে শূন্যতা পূরণ করে চলেছে। আমাদের সুপ্রিম কোর্টের গঠন ভারত ও পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে ঠিক তুলনীয় নয়। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের একক সত্তা। এখন আমরা দেখলাম, আদালত অবমাননার বিচার করতে বসে তাঁরা পৃথক সত্তা হলেন। দুটি কোর্ট অব রেকর্ড হিসেবে ধরা দিলেন।
তাহলে কি আমাদের দুটি আদালত অবমাননা আইন লাগবে, এবং তাতে দুই ধরনের সাজার বিধান থাকবে? ভারত ও পাকিস্তানের সংসদ একটি করে আইন পাস করেছে।
আইন কমিশন আদালত অবমাননা আইনের যে খসড়া তৈরি করেছিল, সেখানে আপিল বিভাগের জন্য আলাদা কোনো বিধানের ব্যবস্থা রাখেনি। ২০০৮ সালে জরুরি অবস্থার মধ্যে ১৯২৬ সালের আইনটি বিলোপ করা হয়। আদালত অবমাননা-সংক্রান্ত আমরা একটি নতুন অধ্যাদেশ পেয়েছিলাম। সেই অধ্যাদেশেও আমরা আপিল বিভাগের অবমাননার জন্য কোনো স্বতন্ত্র বিধান দেখিনি। তত্কালীন অ্যাটর্নি জেনারেলবলেছিলেন, ভুলবশত আপিলবিভাগের কথা বাদ পড়েছে।আপিল বিভাগের বিধিতে কিন্তু আদালত অবমাননা-সংক্রান্ত বিধানাবলি আছে। আমরা বুঝতে চাই, সেখানে দণ্ডাদেশ সম্পর্কে কী বলা আছে? আপিল বিভাগ কেন তাহলে ছয় মাসের জেল দিলেন? সেটা কি ১৯২৬ সালের হাইকোর্টের আইনের অনুসরণ? নাকি তারা একান্ত নিজস্ব বিবেচনায় ছয় মাস নির্দিষ্ট করেছেন? আপিল বিভাগের ১১ বিধিতে লেখা, যে ক্ষেত্রে আদালতের (আপিল বিভাগের) চোখের সামনেই আদালত অবমাননা ঘটবে, সে ক্ষেত্রে দোষী ব্যক্তিকে সংশ্লিষ্ট বিচারক বা চেম্বার জজ বা আদালত ‘আইন অনুযায়ী’ সাজা দেবেন।
সুতরাং হাইকোর্ট এক রকম এবং আপিল বিভাগ ভিন্ন ধরনের সাজা দেবেন? এ ধরনের এখতিয়ার-সংবলিত কোনো ‘আইনের’ অস্তিত্ব আমরা দেখতে পাই না। বরং সংবিধান ও আপিল বিভাগের রুলস আপিল বিভাগকে নির্দিষ্টভাবে ‘আইন অনুযায়ী’ সাজা দিতে বলেছে। সংবিধানের ৩৫(১) অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘অপরাধের দায়যুক্ত কার্যসংঘটনকালে বলবত্ ছিল, এই রূপ আইন ভঙ্গ করিবার অপরাধ ব্যতীত কোনো ব্যক্তিকে দোষী সাব্যস্ত করা যাইবে না। এবং অপরাধ-সংঘটনকালে বলবত্ সেই আইনবলে যে দণ্ড দেওয়া যাইতে পারিত, তাঁহাকে তাহার অধিক বা তাহা হইতে ভিন্ন দণ্ড দেওয়া যাইবে না।’ মাহমুদুর রহমান কি ‘ভিন্ন দণ্ড’ পেলেন?
পাকিস্তান ও ভারতের আদলে আমরাও বাহাত্তরের সংবিধানে ১০৮ অনুচ্ছেদ ধারণ করতে সচেষ্ট ছিলাম। কিন্তু পরে আমরা তা করিনি। ভারত ও পাকিস্তান থেকে সরে দাঁড়াই। সংবিধানপ্রণেতারা যথার্থই ১০৮ অনুচ্ছেদে ‘আইন-সাপেক্ষে’ কথাটি যুক্ত করেন। অবশ্য পরিহাস হলো, আইনের কথাটি যোগ না করেই ভারত ও পাকিস্তান ১৯২৬ সালের আইন বাতিল করেছে। ১৯৫২ সালের পর ১৯৭১ সালে ভারত এবং ১৯৭৬ সালে পাকিস্তান আদালত অবমাননার নতুন আইন করেছে। আমাদের আইন কমিশনও ছয় মাসের জেল ঠিক রাখে। তারা জরিমানার অঙ্ক দুই হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকায় উন্নীত করার প্রস্তাব করেছিল। উপরন্তু ভারত ও পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্ট একই আইনের আওতায় পরিচালিত হচ্ছে। আপিল বিভাগ ও হাইকোর্টের জন্য আলাদা আইন নেই। আলাদা দণ্ড নেই। উন্নত বিশ্বের কোথাও আছে বলেও জানা নেই।
সংবিধান বিশেষজ্ঞ মাহমুদুল ইসলাম তাঁর কনস্টিটিউশনাল ল অব বাংলাদেশ গ্রন্থে হাইকোর্টের এক রায়ের বরাতে বলেছেন, ‘সুপ্রিম কোর্টের দণ্ড প্রদানের ক্ষমতার প্রয়োগ আইনের দ্বারা হতে পারে।’ আমি মনে করি না যে এই মতটি সংবিধানসম্মত। সঠিক ব্যাখ্যা হলো, এটা অবশ্যই আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। ২০০১ সালে পাল্লো শেঠ বনাম কাস্টোডিয়ান মামলায় ভারতের সুপ্রিম কোর্ট একটা কথা সাফ বলেছেন। কথাটি হলো, সাজার পরিমাণটা কী হবে, সেটা নির্ধারণ করে দেওয়া আদালতের ব্যাপার নয়।
এখন প্রশ্ন হলো, আপিল বিভাগ অবমাননা আইন না থাকলে কী হবে। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট সম্প্রতি তর্কিত নজির স্থাপন করেছেন। ২০০৩ সালে সুপ্রিম কোর্টের তিন সদস্যের বেঞ্চ আদালত অবমাননার দায়ে ৫০ হাজার রুপি জরিমানা করেন। ২০০৬ সালে জহিরা হাবিবুল্লাহ মামলায় সুপ্রিম কোর্টের দুই সদস্যের বেঞ্চ বলেন, ‘সুপ্রিম কোর্ট কতটা সাজা দেবে, তা ঠিক করে দেবে আইন। সে আইন নেই। তাই অভিযুক্তাকে আদালত অবমাননার (গোধরার দাঙ্গাসংক্রান্ত মামলায় জহিরা মিথ্যা সাক্ষ্য দেন) দায়ে এক বছর জেল ও ৫০ হাজার রুপি জরিমানা অনাদায়ে আরো এক বছর জেল দেওয়া হলো।’ ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের কর্মরত বিচারপতি মারকান্দে কাজু এ নিয়ে নিবন্ধ লিখলেন। তিনি এলাহাবাদ ও দিল্লি হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি ছিলেন। তিনি এর যথার্থ সমালোচনা করেন। তিনি লিখেছেন, ‘এটা বিস্ময়কর। তাহলে তো সুপ্রিম কোর্ট আদালত অবমাননার দায়ে যে কোনো মেয়াদে সাজা দিতে পারেন! একাত্তরের আইনটি অস্পষ্ট বটে। তাই বলে এমন ব্যাখ্যা চলে না।’
এ পর্যন্ত উচ্চ আদালতের অবমাননার জন্য যত ব্যাখ্যা কিংবা রায় এ দেশের জনগণ জেনেছে, তাতে ১৯২৬ সালের আইনটিই উচ্চারিত হয়েছে। এটি প্রত্যেক ‘কোর্ট অব রেকর্ডের’ জন্য প্রযোজ্য। এটি তাই আপিল বিভাগের জন্যও প্রযোজ্য হওয়া অধিকতর যৌক্তিক। আপিল বিভাগ বলেই তাকে যেকোনো শর্তে দণ্ডদানের অসীম ক্ষমতার অধিকারী ভাবা সংগত নয় বলে মনে করি। ১৯২৬ সালের আইন প্রণয়নের ইতিহাসটাই বলে দেবে বিচারপতি মারকান্দে কাজুর ওই মতামত কতটা যথার্থ। ১৭৭৪ সালের ব্রিটিশ সনদে কলকাতা হাইকোর্টের জন্ম। কলকাতা হাইকোর্টই আমাদের আজকের হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগের পূর্বসূরি। স্মরণাতীতকাল থেকে হাইকোর্ট তার অবমাননার জন্য শাস্তি দিয়ে আসছেন। এই উপমহাদেশে ১৮৮৩ সালে কলকাতা হাইকোর্টের এক মামলায় প্রথম স্থির হলো, হাইকোর্ট দণ্ড দেবেন। তখনো আইন ছিল না। ১৯০৭ সালে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি হলো। তারা প্রশ্ন তুলল। বলল, হাইকোর্টের স্থানীয় সীমার বাইরের আদালতের অবমাননার বিচার হাইকোর্টগুলো করতে পারেন কি না। শুধু এই সংশয় দূর করাটাই তখন জরুরি ছিল। সে জন্য পাস হলো ১৯২৬ সালের আইন। সেখানে কিন্তু তখনই ছয় মাসের জেল ও জরিমানার বিধান লেখা হলো। তদুপরি ১৯৩৭ সালে লাহোর হাইকোর্ট বললেন, ‘আমাদের হাত ঢের লম্বা। আদালত অবমাননার দায়ে আমরা ছয় মাসের বেশি জেল দিতে পারি।’ এর আগে ১৯১৫ ও ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনেও কিন্তু আদালত অবমাননা-সংক্রান্ত নির্দিষ্ট দণ্ডের বিধান ছিল না। রেওয়াজে ভর করে হাইকোর্টগুলো লঘু শাস্তিই দিতেন। লাহোর হাইকোর্টের ওই আদেশের পর ব্রিটিশ সংসদ হাইকোর্টগুলোর ডানা ছাঁটল। সংশোধনী এল, লেখা হলো, এই সীমার বাইরে যাওয়া চলবে না। আজ পর্যন্ত উপমহাদেশের কোথাও তেমন দাবি ওঠেনি এই শাস্তি অপর্যাপ্ত।
এখন এই অঞ্চলের কোনো কোর্ট অব রেকর্ড যদি বলেন আমাদের আইন নেই। তাহলে আমরা কোথায় যাই? ১৯৩৭ সালের আগ পর্যন্ত বলা হতো ব্রিটিশ কিংস বেঞ্চের মতোই ভারতীয় হাইকোর্টগুলোর ক্ষমতা। তাহলে প্রশ্ন ওঠে, আমরা এই মুহূর্তে কোথায় দাঁড়ালাম? নতুন দৃষ্টান্ত আমাদের কতটা পেছনে নেবে? ১৬৩১ খ্রিষ্টাব্দের ব্রিটেনের কথা ভাবুন। প্রধান বিচারপতি রিচার্ডসনের দিকে ইট ছোড়া হলো। এতে আদালত অবমাননা ঘটল। তাঁর ডান হাত কাটা হলো। প্রায় চোখের পলকে আদালতের সামনে নির্মিত হলো ফাঁসিকাষ্ঠ। সেখানে প্রকাশ্যে তাঁর ফাঁসি হলো। ১৬৩৪ সাল। জেমস উইলসন একই অপরাধ করলেন। বেঞ্চের দিকে পাথর ছুড়লেন। তাঁর ডান হাত কাটা হলো। সেই কাটা হাত বহু বছর আদালতের প্রবেশপথে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। সেই আদালতের উত্তরাধিকারী বেঞ্চ তিন শ বছর পর ১৮৯৯ সালে বললেন, ‘আদালত কলঙ্কিত’ করার দায়ে ব্রিটেনে কাউকে দোষী সাব্যস্ত করা পরিত্যক্ত হওয়া উচিত। তবে এর দরকার পড়বে সেই সব ঔপনিবেশিক সমাজে, যেখানে গণতন্ত্র পরিপক্ব হয়নি।’ এর ঠিক ১০০ বছর পর ১৯৯৯ সালে আমরা ব্রিটিশ বেঞ্চের আরেকটি রায় পেলাম। আমরা জানলাম, গত ৬০ বছরে ব্রিটেনে কেউ আদালত কলঙ্কিত করার দায়ে সাজা পায়নি। যদিও ব্রিটেনের ১৯৮১ সালের আদালত অবমাননা আইন দুই বছর জেল ও ২৫০০ পাউন্ড জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। তবে এটা কেতাবের গরু হয়ে আছে। ২০১০ সালে বাংলাদেশের একজন পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ‘আদালত কলঙ্কিত’ করার দায়ে উপমহাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ সাজা পেলেন। এই দৃষ্টান্তমূলক সাজা আমরা মাথা পেতে নিতে পারি, যদি আমরা জানি যে, সংবাদপত্র মিথ্যা ও বানোয়াট তথ্য দিয়ে উচ্চ আদালতকে পরিকল্পিতভাবে কলঙ্কিত করেছিল।
আইনি প্রক্রিয়া নিয়ে কথা বলছিলাম। সেখানেই থাকি। আমরা বাংলাদেশ সংবিধানের ১০৩ অনুচ্ছেদ ভুলে থাকতে পারি না। ১০৮ অনুচ্ছেদের সঙ্গে এটা মিলিয়ে পড়তে হবে। ১০৩ অনুচ্ছেদ তিনটি ক্ষেত্রে দণ্ডিতের আপিলের সংবিধিবদ্ধ অধিকার নিশ্চিত করেছে। এর অন্যতম আদালত অবমাননা। সুতরাং এর দায়ে হাইকোর্টে কেউ দণ্ডিত হলে আপিল বিভাগকে অবশ্যই আপিল শুনতে হবে। এখন আপিল বিভাগ বিচারিক আদালত হলে তাঁর দেওয়া সাজার বিরুদ্ধে আপিল কে শুনবেন?
দণ্ডিতকে অন্তত একটি আপিলের সুযোগদান আইনের শাসনের অন্যতম মূলমন্ত্র। মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধীরও আপিলের সুযোগ আছে। আজ বঙ্গবন্ধুর কোনো পলাতক খুনি ধরা পড়লেই তাঁকে ফাঁসি দেওয়া যাবে না। কারণ, একটিবার আপিলের সুযোগ তাঁর প্রাপ্য। ভারতের সংবিধানের সঙ্গে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সংবিধানের একটা পার্থক্য আছে। সেটি হলো ভারতের সংবিধান নির্দিষ্টভাবে আদালত অবমাননা-সংক্রান্ত আপিলের অধিকার দেয়নি। তবে এটা দিয়েছে তাদের আইন। ভারতের ১৯৭১ সালের আইনে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের সুযোগ অবশ্য রাখা হয়নি। সেদিক থেকে পাকিস্তান উন্নত। কারণ আমরা তাদের ২০০৩ সালের আদালত অবমাননা অধ্যাদেশের ১৯ ধারায় দেখি, সুপ্রিম কোর্টের একক বা দুই সদস্যের বেঞ্চের রায়ের বিরুদ্ধে তিন সদস্যের, আর তিন বা ততোধিক বেঞ্চের রায়ের বিরুদ্ধে পাঁচ বা ততোধিক বিচারক নিয়ে গঠিত বেঞ্চের কাছে আন্ত-সুপ্রিম কোর্ট বা আন্ত-আদালত আপিলের একটা ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এই ব্যবস্থা বাংলাদেশও হয়তো গ্রহণ করতে পারে। আমার দেশ-এর মামলায় সংশ্লিষ্ট চেম্বার জজ শুনানিতে নাও বসতে পারতেন। তাহলেও পাঁচজন থাকতেন। দুই সদস্যের বেঞ্চ রায় দিতেন। তাঁর বিরুদ্ধে তিন সদস্যের বেঞ্চ আপিল শুনতে পারতেন।
আমার দেশ-এর গত ২১ এপ্রিলের প্রতিবেদনে কথিতমতে কিছু সত্য ঘটনার উল্লেখ আছে। এমনকি তর্কিত প্রতিবেদনে টি এইচ খানের মন্তব্য দেখলাম: ‘হাইকোর্টের আদেশ স্থগিত করে দেওয়াটাই যেন চেম্বার জজ আদালতের মূল কাজ। সরকারের পক্ষ থেকে স্থগিতাদেশ চাওয়া হলেই হলো। অনেকটা মুখ দেখেই চেম্বার জজ আদালতে ইদানীং স্থগিতাদেশ দেওয়া হচ্ছে।’ এই মামলার শুনানিকালে আমরা তাঁকে আপিল বিভাগে হাজির দেখেছি। তাঁর কাছে কিছু জানতে চাওয়া হয়েছে বলে জানি না। এর আগেও চেম্বার আদালতকে স্টার চেম্বারের সঙ্গে তুলনা করার মতো বাকস্বাধীনতার অনুশীলন আমরা দেখেছি।
২০০৬ সালে ভারতের আদালত অবমাননা আইন সংশোধন করা হলো। তাদের ইতিহাসে প্রথম বলা হলো, সত্য প্রকাশে বাধা নেই। ২০০৭ সালে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট মুম্বাইয়ের মিড ডে পত্রিকার কয়েকজন সাংবাদিককে চার মাস করে জেল দিলেন। ওই পত্রিকাটি সাবেক প্রধান বিচারপতি ওয়াই. কে. সাবরওয়ালের সম্পত্তি-সংক্রান্ত অনিয়মের বিষয়ে রিপোর্ট করেছিল। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট সত্যাসত্য যাচাইয়ে যাননি। ওই সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত হতে পারিনি। কী ভাষায় সমালোচনা করা যায়? মোরারজি দেশাই মন্ত্রিসভার জাঁদরেল আইনমন্ত্রী শান্তি ভূষণ। ইন্দিরা গান্ধীর বিরুদ্ধে জয়প্রকাশ নারায়ণ ও অরুন্ধতী রায়ের আদালত অবমাননা মামলায় অরুন্ধতীর পক্ষে আইনজীবী ছিলেন। তাঁর মন্তব্য: ‘২০০৬ সালের সংশোধনী মতে, পত্রিকার রিপোর্ট সঠিক বলে প্রমাণিত হলে আদালত অবমাননা ঘটত না। তাই রায় সম্পর্কে বলা চলে, তাদের (সুপ্রিম কোর্টের) একমাত্র লক্ষ্য হলো গণমাধ্যমকে আতঙ্কিত করা এবং সত্যবাদিতার টুঁটি চেপে ধরা।’
আয়ারল্যান্ড সুপ্রিম কোর্টের ১৯৮১ সালের একটি রায় বলেছে, ‘আদালত অবমাননা-সংক্রান্ত শুনানির পয়লা শর্ত হলো তথ্য ও আইনি উভয়বিধ দিক থেকে আনীত অভিযোগ যাচাই করতে হবে।’ আমার দেশ মামলার শুনানিতে আমরা তা দেখলাম না। তাই পূর্ণাঙ্গ রায়ের জন্য অপেক্ষায় রইলাম।
আমরা আমাদের আপিল বিভাগকে অত্যন্ত উঁচু আসনেই রাখতে চাই। দণ্ডিত সম্পাদকের দ্বিতীয় মামলার প্রস্তাবিত শুনানি প্রলম্বিত করা যেতে পারে। সচিবদের আদালত অবমাননাসহ বহু পুরোনো অবমাননা মামলা আপিল বিভাগে ঝুলে আছে। ১৯ আগস্টের পূর্ণাঙ্গ রায় দ্রুত পাওয়া দরকার। সেটা পড়ে দণ্ডিতরা তাঁদের কোনো প্রকৃত ভুলের জন্য ক্ষমা চাইতে পারেন কি পারেন না, সেটা ভিন্ন প্রশ্ন। কিন্তু দণ্ডভোগ করার আগেই দোষী সাব্যস্ত হওয়ার বিস্তারিত কারণ জানা তাঁদের অধিকার। তাঁরা দণ্ড পুনর্বিবেচনার সুযোগ পেতে পারেন। এখানে তো অভিযোগকারী নিজেই বিচারক। সুতরাং এখানে অনুকম্পা, মার্জনা ও নমনীয়তা প্রদর্শনের সুযোগ সর্বোচ্চ থাকা প্রত্যাশিত। এবং তেমনটা জনগণের কাছে প্রতীয়মান হওয়া আইনের শাসনের চেতনাসঞ্জাত মনে করি। এই পোড়া দেশে বাক ও সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতার বিকাশে উচ্চ আদালতের অসামান্য ভূমিকা পালনের সুযোগ আছে।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
তবে আমাদের অস্বস্তি আমার দেশ-এর তর্কিত প্রতিবেদনের সত্য-মিথ্যা যাচাই হওয়ার বিষয়টি। লেখক হিসেবে সেই আশায় ছিলাম। আদালত অবমাননা নানাভাবে ঘটতে পারে। শুধু যে বিচারক বা আইনজীবীরাই আদালতের ভাবমূর্তি রক্ষার অতন্দ্রপ্রহরী, তা তো নয়। কারণ কোনো বিচারকের ব্যক্তিগত সুনামহানি থেকে রক্ষা করার জন্য আদালতকে এই ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। আদালত অবমাননার সঙ্গে বাকস্বাধীনতা ও মৌলিক মানবাধিকারের একটা চিরকালীন দ্বন্দ্ব আছে। আমরা দুর্ভাগা। আমরা কতটা কী লিখতে পারি বা পারি না, তা সংসদ বা আদালত কেউ আমাদের ঠিক করে দিলেন না।
আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় এলে এ বিষয়ে একটি পরিষ্কার চিত্র পাওয়া যাবে, এমন আশা আমরা করি। এবং তখন এ বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ মতামত দেওয়া যাবে। আদালত যখন বলেন যে তাঁর রায়ের সমালোচনা চলবে, তখন আমরা ভাবি, কত তাড়াতাড়ি আমরা পূর্ণাঙ্গ রায় পাব। আদালত বা সংসদ কেউ তো আমাদের বলে দেন না যে, যুক্তিসংগত বাধা-নিষেধটা কী। এ বিষয়ে ভারতের বিস্তারিত আইন আছে। তদুপরি কিসে আদালত অবমাননা হয় না, তার একটি নীতিমালাও ভারতের সুপ্রিম কোর্ট করে দিয়েছেন। পাকিস্তানের আইন দেখেও ঈর্ষা হয়। সেটাও যথেষ্ট বিস্তারিত। মিথ্যা ও বিকৃত তথ্য ছাপলেই আদালত অবমাননা হবে না, প্রমাণিত হতে হবে যে উদ্দেশ্যটা বিদ্বেষপ্রসূত ছিল কি না। পাকিস্তান এত দূর গেলে আমরা পারি না কেন? আমরা অন্ধকারে হাতড়ে বেড়াই। ২০০৮ সালের আদালত অবমাননা আইন বাতিল হয় হাইকোর্টে। বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক রায় দেন, ‘কোন কোন ক্ষেত্রে বা কী পরিস্থিতিতে আদালত অবমাননা হইবে না বা হইবে, তাহা নির্ধারণ করিবার দায়িত্ব আদালতের। ইহা কোন অধ্যাদেশ দ্বারা সম্পূর্ণভাবে (exhaustively) নির্ধারণ করা যায় না।’
আজকের লেখায় আমি অবশ্য এ-সংক্রান্ত আইনগত ফাঁকফোকর ও দণ্ড প্রদানের দিকটি পর্যালোচনা করতে চাইব। আমরা এত দিন জেনে এসেছি যে আদালত অবমাননার জন্য ছয় মাসের জেল আর দুই হাজার টাকা জরিমানার বিধান আছে। এবার আমরা সম্পূর্ণ নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হলাম। সে কারণেই এই আলোচনা।
বর্তমানে রাজরোষে থাকা ‘বাই চান্স’ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানেরা এ সমাজের চেনা উত্পাত। তাঁর বহু কাণ্ডকীর্তি বিতর্কিত, যা আমাদের কাছে অগ্রহণযোগ্য। সংবাদপত্র আর প্রচারপত্রের সীমারেখা মানতে তিনি উদগ্রীব, তার প্রমাণ পাই না। তবে সে ভিন্ন প্রসঙ্গ।
আমরা জানতাম, ১৯২৬ সালের একটা আদালত অবমাননা আইন আছে। এতে সর্বোচ্চ ছয় মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড কিংবা দুই হাজার টাকা জরিমানা কিংবা উভয়বিধ সাজা দেওয়া যাবে। তাহলে প্রথম খটকা হলো, তাঁর ছয় মাস জেল হলো। এক লাখ টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও এক মাসের জেল হলো। অন্য আরও দুজনের ১০ হাজার টাকা করে জরিমানা হলো। কিন্তু কী করে?
সাবেক প্রধান বিচারপতি মোস্তাফা কামাল আইন কমিশনের চেয়ারম্যান ছিলেন। আদালত অবমাননা বিষয়ে তাঁর তৈরি করা ১৩ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন আছে। সেটা পড়ে আমরা নিশ্চিত জানলাম, ১৯২৬ সালের আইনটি শুধু হাইকোর্ট বিভাগের জন্য প্রযোজ্য, আপিল বিভাগের জন্য নয়। আপিল বিভাগ তাহলে কোন আইনের কোন ধারার আওতায় সাজা দিলেন? এর ভিত্তি কী? অ্যাটর্নি জেনারেল মাহ্বুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন, ‘আপিল বিভাগের বিধিমালা ও সংবিধানের ১০৮ অনুচ্ছেদ অনুসারে আদালত দোষী সাব্যস্ত করে সাজার রায় দিয়েছেন।’ ১৯ আগস্ট আপিল বিভাগের সংক্ষিপ্ত আদেশে দেখলাম, ১০৮ অনুচ্ছেদের কথা আছে। সেখানে ১৯২৬ সালের আইনের উল্লেখ নেই। তবে আপিল বিভাগের সংক্ষিপ্ত আদেশেই তথ্য পেলাম, সাজার ব্যাপারে প্রধান বিচারপতিসহ ছয় বিচারপতি একমত হয়েছেন। কিন্তু সাজার মেয়াদ প্রশ্নে রায় বিভক্ত হয়েছে। ৫: ১ ভোটে সাজার মেয়াদ বহাল হয়।
বাংলাদেশ সংবিধানের ১০৮ অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘সুপ্রিম কোর্ট একটি কোর্ট অব রেকর্ড হইবেন এবং ইহার অবমাননার জন্য তদন্তের আদেশদান বা দণ্ডাদেশদানের ক্ষমতাসহ আইন-সাপেক্ষে অনুরূপ আদালতের সকল ক্ষমতার অধিকারী থাকিবেন।’ এর সরল অর্থ দাঁড়াচ্ছে, আদালত অবমাননার অপরাধের বিচারের এখতিয়ার সুপ্রিম কোর্টকে দেওয়া আছে। সুপ্রিম কোর্ট উভয় বিভাগ নিয়ে গঠিত। এখানে ‘আইন-সাপেক্ষ’ কথাটি গুরুত্বপূর্ণ। সংবিধান সুপ্রিম কোর্টকে বলছে, আপনাকে এই অভিযোগ বিচারের ক্ষমতাটা দিলাম। কিন্তু এর প্রয়োগ করবেন ‘আইনের’ আওতায়। কিন্তু সেই আইন নেই। ১৯২৬ সালের আইনটি সেই আইন নয়। তবে শূন্যতা পূরণ করে চলেছে। আমাদের সুপ্রিম কোর্টের গঠন ভারত ও পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে ঠিক তুলনীয় নয়। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের একক সত্তা। এখন আমরা দেখলাম, আদালত অবমাননার বিচার করতে বসে তাঁরা পৃথক সত্তা হলেন। দুটি কোর্ট অব রেকর্ড হিসেবে ধরা দিলেন।
তাহলে কি আমাদের দুটি আদালত অবমাননা আইন লাগবে, এবং তাতে দুই ধরনের সাজার বিধান থাকবে? ভারত ও পাকিস্তানের সংসদ একটি করে আইন পাস করেছে।
আইন কমিশন আদালত অবমাননা আইনের যে খসড়া তৈরি করেছিল, সেখানে আপিল বিভাগের জন্য আলাদা কোনো বিধানের ব্যবস্থা রাখেনি। ২০০৮ সালে জরুরি অবস্থার মধ্যে ১৯২৬ সালের আইনটি বিলোপ করা হয়। আদালত অবমাননা-সংক্রান্ত আমরা একটি নতুন অধ্যাদেশ পেয়েছিলাম। সেই অধ্যাদেশেও আমরা আপিল বিভাগের অবমাননার জন্য কোনো স্বতন্ত্র বিধান দেখিনি। তত্কালীন অ্যাটর্নি জেনারেলবলেছিলেন, ভুলবশত আপিলবিভাগের কথা বাদ পড়েছে।আপিল বিভাগের বিধিতে কিন্তু আদালত অবমাননা-সংক্রান্ত বিধানাবলি আছে। আমরা বুঝতে চাই, সেখানে দণ্ডাদেশ সম্পর্কে কী বলা আছে? আপিল বিভাগ কেন তাহলে ছয় মাসের জেল দিলেন? সেটা কি ১৯২৬ সালের হাইকোর্টের আইনের অনুসরণ? নাকি তারা একান্ত নিজস্ব বিবেচনায় ছয় মাস নির্দিষ্ট করেছেন? আপিল বিভাগের ১১ বিধিতে লেখা, যে ক্ষেত্রে আদালতের (আপিল বিভাগের) চোখের সামনেই আদালত অবমাননা ঘটবে, সে ক্ষেত্রে দোষী ব্যক্তিকে সংশ্লিষ্ট বিচারক বা চেম্বার জজ বা আদালত ‘আইন অনুযায়ী’ সাজা দেবেন।
সুতরাং হাইকোর্ট এক রকম এবং আপিল বিভাগ ভিন্ন ধরনের সাজা দেবেন? এ ধরনের এখতিয়ার-সংবলিত কোনো ‘আইনের’ অস্তিত্ব আমরা দেখতে পাই না। বরং সংবিধান ও আপিল বিভাগের রুলস আপিল বিভাগকে নির্দিষ্টভাবে ‘আইন অনুযায়ী’ সাজা দিতে বলেছে। সংবিধানের ৩৫(১) অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘অপরাধের দায়যুক্ত কার্যসংঘটনকালে বলবত্ ছিল, এই রূপ আইন ভঙ্গ করিবার অপরাধ ব্যতীত কোনো ব্যক্তিকে দোষী সাব্যস্ত করা যাইবে না। এবং অপরাধ-সংঘটনকালে বলবত্ সেই আইনবলে যে দণ্ড দেওয়া যাইতে পারিত, তাঁহাকে তাহার অধিক বা তাহা হইতে ভিন্ন দণ্ড দেওয়া যাইবে না।’ মাহমুদুর রহমান কি ‘ভিন্ন দণ্ড’ পেলেন?
পাকিস্তান ও ভারতের আদলে আমরাও বাহাত্তরের সংবিধানে ১০৮ অনুচ্ছেদ ধারণ করতে সচেষ্ট ছিলাম। কিন্তু পরে আমরা তা করিনি। ভারত ও পাকিস্তান থেকে সরে দাঁড়াই। সংবিধানপ্রণেতারা যথার্থই ১০৮ অনুচ্ছেদে ‘আইন-সাপেক্ষে’ কথাটি যুক্ত করেন। অবশ্য পরিহাস হলো, আইনের কথাটি যোগ না করেই ভারত ও পাকিস্তান ১৯২৬ সালের আইন বাতিল করেছে। ১৯৫২ সালের পর ১৯৭১ সালে ভারত এবং ১৯৭৬ সালে পাকিস্তান আদালত অবমাননার নতুন আইন করেছে। আমাদের আইন কমিশনও ছয় মাসের জেল ঠিক রাখে। তারা জরিমানার অঙ্ক দুই হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকায় উন্নীত করার প্রস্তাব করেছিল। উপরন্তু ভারত ও পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্ট একই আইনের আওতায় পরিচালিত হচ্ছে। আপিল বিভাগ ও হাইকোর্টের জন্য আলাদা আইন নেই। আলাদা দণ্ড নেই। উন্নত বিশ্বের কোথাও আছে বলেও জানা নেই।
সংবিধান বিশেষজ্ঞ মাহমুদুল ইসলাম তাঁর কনস্টিটিউশনাল ল অব বাংলাদেশ গ্রন্থে হাইকোর্টের এক রায়ের বরাতে বলেছেন, ‘সুপ্রিম কোর্টের দণ্ড প্রদানের ক্ষমতার প্রয়োগ আইনের দ্বারা হতে পারে।’ আমি মনে করি না যে এই মতটি সংবিধানসম্মত। সঠিক ব্যাখ্যা হলো, এটা অবশ্যই আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। ২০০১ সালে পাল্লো শেঠ বনাম কাস্টোডিয়ান মামলায় ভারতের সুপ্রিম কোর্ট একটা কথা সাফ বলেছেন। কথাটি হলো, সাজার পরিমাণটা কী হবে, সেটা নির্ধারণ করে দেওয়া আদালতের ব্যাপার নয়।
এখন প্রশ্ন হলো, আপিল বিভাগ অবমাননা আইন না থাকলে কী হবে। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট সম্প্রতি তর্কিত নজির স্থাপন করেছেন। ২০০৩ সালে সুপ্রিম কোর্টের তিন সদস্যের বেঞ্চ আদালত অবমাননার দায়ে ৫০ হাজার রুপি জরিমানা করেন। ২০০৬ সালে জহিরা হাবিবুল্লাহ মামলায় সুপ্রিম কোর্টের দুই সদস্যের বেঞ্চ বলেন, ‘সুপ্রিম কোর্ট কতটা সাজা দেবে, তা ঠিক করে দেবে আইন। সে আইন নেই। তাই অভিযুক্তাকে আদালত অবমাননার (গোধরার দাঙ্গাসংক্রান্ত মামলায় জহিরা মিথ্যা সাক্ষ্য দেন) দায়ে এক বছর জেল ও ৫০ হাজার রুপি জরিমানা অনাদায়ে আরো এক বছর জেল দেওয়া হলো।’ ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের কর্মরত বিচারপতি মারকান্দে কাজু এ নিয়ে নিবন্ধ লিখলেন। তিনি এলাহাবাদ ও দিল্লি হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি ছিলেন। তিনি এর যথার্থ সমালোচনা করেন। তিনি লিখেছেন, ‘এটা বিস্ময়কর। তাহলে তো সুপ্রিম কোর্ট আদালত অবমাননার দায়ে যে কোনো মেয়াদে সাজা দিতে পারেন! একাত্তরের আইনটি অস্পষ্ট বটে। তাই বলে এমন ব্যাখ্যা চলে না।’
এ পর্যন্ত উচ্চ আদালতের অবমাননার জন্য যত ব্যাখ্যা কিংবা রায় এ দেশের জনগণ জেনেছে, তাতে ১৯২৬ সালের আইনটিই উচ্চারিত হয়েছে। এটি প্রত্যেক ‘কোর্ট অব রেকর্ডের’ জন্য প্রযোজ্য। এটি তাই আপিল বিভাগের জন্যও প্রযোজ্য হওয়া অধিকতর যৌক্তিক। আপিল বিভাগ বলেই তাকে যেকোনো শর্তে দণ্ডদানের অসীম ক্ষমতার অধিকারী ভাবা সংগত নয় বলে মনে করি। ১৯২৬ সালের আইন প্রণয়নের ইতিহাসটাই বলে দেবে বিচারপতি মারকান্দে কাজুর ওই মতামত কতটা যথার্থ। ১৭৭৪ সালের ব্রিটিশ সনদে কলকাতা হাইকোর্টের জন্ম। কলকাতা হাইকোর্টই আমাদের আজকের হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগের পূর্বসূরি। স্মরণাতীতকাল থেকে হাইকোর্ট তার অবমাননার জন্য শাস্তি দিয়ে আসছেন। এই উপমহাদেশে ১৮৮৩ সালে কলকাতা হাইকোর্টের এক মামলায় প্রথম স্থির হলো, হাইকোর্ট দণ্ড দেবেন। তখনো আইন ছিল না। ১৯০৭ সালে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি হলো। তারা প্রশ্ন তুলল। বলল, হাইকোর্টের স্থানীয় সীমার বাইরের আদালতের অবমাননার বিচার হাইকোর্টগুলো করতে পারেন কি না। শুধু এই সংশয় দূর করাটাই তখন জরুরি ছিল। সে জন্য পাস হলো ১৯২৬ সালের আইন। সেখানে কিন্তু তখনই ছয় মাসের জেল ও জরিমানার বিধান লেখা হলো। তদুপরি ১৯৩৭ সালে লাহোর হাইকোর্ট বললেন, ‘আমাদের হাত ঢের লম্বা। আদালত অবমাননার দায়ে আমরা ছয় মাসের বেশি জেল দিতে পারি।’ এর আগে ১৯১৫ ও ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনেও কিন্তু আদালত অবমাননা-সংক্রান্ত নির্দিষ্ট দণ্ডের বিধান ছিল না। রেওয়াজে ভর করে হাইকোর্টগুলো লঘু শাস্তিই দিতেন। লাহোর হাইকোর্টের ওই আদেশের পর ব্রিটিশ সংসদ হাইকোর্টগুলোর ডানা ছাঁটল। সংশোধনী এল, লেখা হলো, এই সীমার বাইরে যাওয়া চলবে না। আজ পর্যন্ত উপমহাদেশের কোথাও তেমন দাবি ওঠেনি এই শাস্তি অপর্যাপ্ত।
এখন এই অঞ্চলের কোনো কোর্ট অব রেকর্ড যদি বলেন আমাদের আইন নেই। তাহলে আমরা কোথায় যাই? ১৯৩৭ সালের আগ পর্যন্ত বলা হতো ব্রিটিশ কিংস বেঞ্চের মতোই ভারতীয় হাইকোর্টগুলোর ক্ষমতা। তাহলে প্রশ্ন ওঠে, আমরা এই মুহূর্তে কোথায় দাঁড়ালাম? নতুন দৃষ্টান্ত আমাদের কতটা পেছনে নেবে? ১৬৩১ খ্রিষ্টাব্দের ব্রিটেনের কথা ভাবুন। প্রধান বিচারপতি রিচার্ডসনের দিকে ইট ছোড়া হলো। এতে আদালত অবমাননা ঘটল। তাঁর ডান হাত কাটা হলো। প্রায় চোখের পলকে আদালতের সামনে নির্মিত হলো ফাঁসিকাষ্ঠ। সেখানে প্রকাশ্যে তাঁর ফাঁসি হলো। ১৬৩৪ সাল। জেমস উইলসন একই অপরাধ করলেন। বেঞ্চের দিকে পাথর ছুড়লেন। তাঁর ডান হাত কাটা হলো। সেই কাটা হাত বহু বছর আদালতের প্রবেশপথে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। সেই আদালতের উত্তরাধিকারী বেঞ্চ তিন শ বছর পর ১৮৯৯ সালে বললেন, ‘আদালত কলঙ্কিত’ করার দায়ে ব্রিটেনে কাউকে দোষী সাব্যস্ত করা পরিত্যক্ত হওয়া উচিত। তবে এর দরকার পড়বে সেই সব ঔপনিবেশিক সমাজে, যেখানে গণতন্ত্র পরিপক্ব হয়নি।’ এর ঠিক ১০০ বছর পর ১৯৯৯ সালে আমরা ব্রিটিশ বেঞ্চের আরেকটি রায় পেলাম। আমরা জানলাম, গত ৬০ বছরে ব্রিটেনে কেউ আদালত কলঙ্কিত করার দায়ে সাজা পায়নি। যদিও ব্রিটেনের ১৯৮১ সালের আদালত অবমাননা আইন দুই বছর জেল ও ২৫০০ পাউন্ড জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। তবে এটা কেতাবের গরু হয়ে আছে। ২০১০ সালে বাংলাদেশের একজন পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ‘আদালত কলঙ্কিত’ করার দায়ে উপমহাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ সাজা পেলেন। এই দৃষ্টান্তমূলক সাজা আমরা মাথা পেতে নিতে পারি, যদি আমরা জানি যে, সংবাদপত্র মিথ্যা ও বানোয়াট তথ্য দিয়ে উচ্চ আদালতকে পরিকল্পিতভাবে কলঙ্কিত করেছিল।
আইনি প্রক্রিয়া নিয়ে কথা বলছিলাম। সেখানেই থাকি। আমরা বাংলাদেশ সংবিধানের ১০৩ অনুচ্ছেদ ভুলে থাকতে পারি না। ১০৮ অনুচ্ছেদের সঙ্গে এটা মিলিয়ে পড়তে হবে। ১০৩ অনুচ্ছেদ তিনটি ক্ষেত্রে দণ্ডিতের আপিলের সংবিধিবদ্ধ অধিকার নিশ্চিত করেছে। এর অন্যতম আদালত অবমাননা। সুতরাং এর দায়ে হাইকোর্টে কেউ দণ্ডিত হলে আপিল বিভাগকে অবশ্যই আপিল শুনতে হবে। এখন আপিল বিভাগ বিচারিক আদালত হলে তাঁর দেওয়া সাজার বিরুদ্ধে আপিল কে শুনবেন?
দণ্ডিতকে অন্তত একটি আপিলের সুযোগদান আইনের শাসনের অন্যতম মূলমন্ত্র। মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধীরও আপিলের সুযোগ আছে। আজ বঙ্গবন্ধুর কোনো পলাতক খুনি ধরা পড়লেই তাঁকে ফাঁসি দেওয়া যাবে না। কারণ, একটিবার আপিলের সুযোগ তাঁর প্রাপ্য। ভারতের সংবিধানের সঙ্গে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সংবিধানের একটা পার্থক্য আছে। সেটি হলো ভারতের সংবিধান নির্দিষ্টভাবে আদালত অবমাননা-সংক্রান্ত আপিলের অধিকার দেয়নি। তবে এটা দিয়েছে তাদের আইন। ভারতের ১৯৭১ সালের আইনে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের সুযোগ অবশ্য রাখা হয়নি। সেদিক থেকে পাকিস্তান উন্নত। কারণ আমরা তাদের ২০০৩ সালের আদালত অবমাননা অধ্যাদেশের ১৯ ধারায় দেখি, সুপ্রিম কোর্টের একক বা দুই সদস্যের বেঞ্চের রায়ের বিরুদ্ধে তিন সদস্যের, আর তিন বা ততোধিক বেঞ্চের রায়ের বিরুদ্ধে পাঁচ বা ততোধিক বিচারক নিয়ে গঠিত বেঞ্চের কাছে আন্ত-সুপ্রিম কোর্ট বা আন্ত-আদালত আপিলের একটা ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এই ব্যবস্থা বাংলাদেশও হয়তো গ্রহণ করতে পারে। আমার দেশ-এর মামলায় সংশ্লিষ্ট চেম্বার জজ শুনানিতে নাও বসতে পারতেন। তাহলেও পাঁচজন থাকতেন। দুই সদস্যের বেঞ্চ রায় দিতেন। তাঁর বিরুদ্ধে তিন সদস্যের বেঞ্চ আপিল শুনতে পারতেন।
আমার দেশ-এর গত ২১ এপ্রিলের প্রতিবেদনে কথিতমতে কিছু সত্য ঘটনার উল্লেখ আছে। এমনকি তর্কিত প্রতিবেদনে টি এইচ খানের মন্তব্য দেখলাম: ‘হাইকোর্টের আদেশ স্থগিত করে দেওয়াটাই যেন চেম্বার জজ আদালতের মূল কাজ। সরকারের পক্ষ থেকে স্থগিতাদেশ চাওয়া হলেই হলো। অনেকটা মুখ দেখেই চেম্বার জজ আদালতে ইদানীং স্থগিতাদেশ দেওয়া হচ্ছে।’ এই মামলার শুনানিকালে আমরা তাঁকে আপিল বিভাগে হাজির দেখেছি। তাঁর কাছে কিছু জানতে চাওয়া হয়েছে বলে জানি না। এর আগেও চেম্বার আদালতকে স্টার চেম্বারের সঙ্গে তুলনা করার মতো বাকস্বাধীনতার অনুশীলন আমরা দেখেছি।
২০০৬ সালে ভারতের আদালত অবমাননা আইন সংশোধন করা হলো। তাদের ইতিহাসে প্রথম বলা হলো, সত্য প্রকাশে বাধা নেই। ২০০৭ সালে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট মুম্বাইয়ের মিড ডে পত্রিকার কয়েকজন সাংবাদিককে চার মাস করে জেল দিলেন। ওই পত্রিকাটি সাবেক প্রধান বিচারপতি ওয়াই. কে. সাবরওয়ালের সম্পত্তি-সংক্রান্ত অনিয়মের বিষয়ে রিপোর্ট করেছিল। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট সত্যাসত্য যাচাইয়ে যাননি। ওই সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত হতে পারিনি। কী ভাষায় সমালোচনা করা যায়? মোরারজি দেশাই মন্ত্রিসভার জাঁদরেল আইনমন্ত্রী শান্তি ভূষণ। ইন্দিরা গান্ধীর বিরুদ্ধে জয়প্রকাশ নারায়ণ ও অরুন্ধতী রায়ের আদালত অবমাননা মামলায় অরুন্ধতীর পক্ষে আইনজীবী ছিলেন। তাঁর মন্তব্য: ‘২০০৬ সালের সংশোধনী মতে, পত্রিকার রিপোর্ট সঠিক বলে প্রমাণিত হলে আদালত অবমাননা ঘটত না। তাই রায় সম্পর্কে বলা চলে, তাদের (সুপ্রিম কোর্টের) একমাত্র লক্ষ্য হলো গণমাধ্যমকে আতঙ্কিত করা এবং সত্যবাদিতার টুঁটি চেপে ধরা।’
আয়ারল্যান্ড সুপ্রিম কোর্টের ১৯৮১ সালের একটি রায় বলেছে, ‘আদালত অবমাননা-সংক্রান্ত শুনানির পয়লা শর্ত হলো তথ্য ও আইনি উভয়বিধ দিক থেকে আনীত অভিযোগ যাচাই করতে হবে।’ আমার দেশ মামলার শুনানিতে আমরা তা দেখলাম না। তাই পূর্ণাঙ্গ রায়ের জন্য অপেক্ষায় রইলাম।
আমরা আমাদের আপিল বিভাগকে অত্যন্ত উঁচু আসনেই রাখতে চাই। দণ্ডিত সম্পাদকের দ্বিতীয় মামলার প্রস্তাবিত শুনানি প্রলম্বিত করা যেতে পারে। সচিবদের আদালত অবমাননাসহ বহু পুরোনো অবমাননা মামলা আপিল বিভাগে ঝুলে আছে। ১৯ আগস্টের পূর্ণাঙ্গ রায় দ্রুত পাওয়া দরকার। সেটা পড়ে দণ্ডিতরা তাঁদের কোনো প্রকৃত ভুলের জন্য ক্ষমা চাইতে পারেন কি পারেন না, সেটা ভিন্ন প্রশ্ন। কিন্তু দণ্ডভোগ করার আগেই দোষী সাব্যস্ত হওয়ার বিস্তারিত কারণ জানা তাঁদের অধিকার। তাঁরা দণ্ড পুনর্বিবেচনার সুযোগ পেতে পারেন। এখানে তো অভিযোগকারী নিজেই বিচারক। সুতরাং এখানে অনুকম্পা, মার্জনা ও নমনীয়তা প্রদর্শনের সুযোগ সর্বোচ্চ থাকা প্রত্যাশিত। এবং তেমনটা জনগণের কাছে প্রতীয়মান হওয়া আইনের শাসনের চেতনাসঞ্জাত মনে করি। এই পোড়া দেশে বাক ও সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতার বিকাশে উচ্চ আদালতের অসামান্য ভূমিকা পালনের সুযোগ আছে।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
0 comments:
Post a Comment